রাত ১০টায় ফোন দিলেন আরমান ভাই – ভাই কালকে পাহড়ে ঢুকতেছি, কাজ কাম না থাকলে চইলা আসেন। পরদিন আমার অনেক কাজ, পুরা দুনিয়া উঠাইয়া এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায় নেওয়ার মত ঝামেলা মাথার উপরে। তাই তাকে বললাম যে যেতে পারছি না। ফোন রেখে ব্যাগ গুছাচ্ছি, অফিস থেকে বাসায় যাবো, হটাত করেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো পাহাড়ের সারি! অটল অবিচল সবুজ পাহাড় ধবধবে সাদা মেঘের ভেতরে গলা ডূবিয়ে বসে আছে, তার মাথায় সবুজ চুলগুলোতে একটানা বাতাসে দোল খেতে খেতে শিস দিচ্ছে ফিঙ্গে পাখির ছানা। আর সবকিছু ছাপিয়ে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে বিরামহীন ছরছর শব্দ। হাজার শব্দের মাঝেও এই শব্দকে আলাদা করে চিনি আমি, মনের ভেতরে খুশির ফোয়ারা ছড়িয়ে দেয়া মন প্রাণ নাচানো এই শব্দ – ঝরনার পানির শব্দ। মাথা ঝাড়া দিয়ে চোখ ফেরালাম সাদা দেয়াল থেকে। মনঃস্থির করা হয়ে গেছে, চুলোয় যাক কাজ, পাহাড় আমাকে ডাকছে, এই ডাক উপেক্ষা করার মতন কলিজা এখনো আমার হয়নাই। অফিসের হাসান ভাইকে রীতিমতন বেঁধে ধরে এক কাপড়েই সায়েদাবাদ রওয়ানা দিলাম, ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ২টা ছুঁই ছুঁই ত্ততক্ষণে আমরা ছেড়ে গেছি ধুলোর নগরী ঢাকার সীমানা – গন্তব্য মীরসরাই।
ভোর ৫টার কিছুক্ষণ আগে মীরসরাই বাজারে নেমে আরো কিছুদূর এগিয়ে গেলাম খইয়াছড়া বিদ্যালয়ের মাঠে, চট্টগ্রাম থেকে আরমান, কালপুরুষ অপু আর লিমন ভাইয়ের আসতে সময় লাগবে আরো ৩ ঘন্টা। কাজেই এই তিনঘণ্টার জন্য উদ্বাস্তু আমরা। সাজানো গোছানো স্কুলের বারান্দায় গামছা পেতে শুয়ে পড়লাম আমি আর হাসান ভাই, পুব আকাশে ততক্ষনে আগুন লেগে গেছে! সূর্যের প্রথম আলো কেটে কুটে ফালাফালা করে দিচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা মেঘের সারিকে, ভোরের বাতাসের এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে উদ্ভ্রান্ত মেঘের দল। ঘুম মাথায় উঠলো, শুয়ে শুয়েই দেখলাম মীরসরাইয়ের পাহাড়ের ওপাশ থেকে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। ততক্ষণে চলে এসেছে আমাদের চট্টগ্রামের পাহাড়ী বাহিনী, আর দেরী নয় পেটে দুটো পরোটা দিয়েই পা চালালাম পূবের পাহাড় লক্ষ্য করে। কালপুরুষ অপু’র কাছে জানলাম এই এলাকায় একটা ঝরণা আছে, কোনো নাম নেই এটার, যেহেতু খইয়াছড়া এলাকাতে অবস্থিত তাই স্থানীয়রা একে “খইয়াছড়া ঝর্না” বলে। আমরা জাচ্ছি এই ঝর্না দেখার জন্যই।
খইয়াছড়া স্কুলের উল্টাপাশের মেইন রোড থেকে পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে ট্রেনলাইন পর্যন্ত, সেখান থেকে মেঠোপথ আর ক্ষেতের আইলের শুরু। তারপর হটাত করেই যেন মাটি সরে গিয়ে উদয় হলো একটা ঝিড়িপথের। টলটলে শান্ত পানির চুপচাপ বয়ে চলার ধরণই বলে দিচ্ছে এর উৎস অবশ্যই বিশাল কিছু থেকে। স্থানীয় লোকদের ক্ষেতের আইলের পাশে বেড়ে উঠেছে আম, নারকেল আর পেঁপের বাগান। একটা বিশাল জাম গাছে পেকে টসটসে হয়ে ঝুলে আছে অজস্র জাম, হাত দিয়ে একটা পাতা টানতেই ঝরঝর করে পড়ে গেলো অনেকগুলো, সে কি মিস্টি! চলতি পথে এর বাড়ির উঠান, ওর বাড়ির সীমানা পেরিয়ে অবশেষে ঢুকলাম পাহাড়ের মূল সীমানায়। এরপরে শুধু ঝিরিপথ ধরে এগিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদেরকে আমরা আবিস্কার করলাম লাল আর নীল রঙের ফড়িংএর মিছিলে! যতদূর পর্যন্ত ঝিড়িপথ গেছে ততদুর পর্যন্ত তাদের মনমাতানো গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পাচ্ছি পানি পড়ার শব্দ, প্রকৃতি এখানে খুব শান্ত, কোথাও কোনো আওয়াজ নেই, চারপাশে মন ভালো করে দেয়া সবুজ দোল খাচ্ছে ফড়িংএর পাখায়। একটু দূরে কোনো একটা প্রাণী ডেকে উঠলো, লিমন ভাই জানালো ওটা মায়া হরিণ। হরিণের ডাক আবার শোনার জন্য কান খাড়া করে ফেললাম, তার বদলে শোনা যাচ্ছে একটানা ঝিমঝিম শব্দ! ঐ শব্দের উৎসের দিকেই আমাদের যাত্রা। কিছুদূর হেঁটে একটা মোড় ঘুরতেই চোখের সামনে নিজের বিশালতা নিয়ে ঝুপ করে হাজির হলো খইয়াছড়া ঝর্ণা, অনেক উপর থেকে একটানা পানি পড়ছে, হা করে দেখার মতন কিছু নেই, এমন ঝর্ণা আমি এর আগেও গোটা বিশেক দেখেছি। কালপুরুষ অপু জানালো এটা নাকি এই ঝরণার শেষ ধাপ! বলে কি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, আরো আছে নাকি? সে হাসলো, আমাকে বললো দম বন্ধ করতে, সৌন্দর্যের শুরু নাকি এখান থেকেই, এলাকার লোকজন সব নাকি এখান পর্যন্ত এসেই চলে যায়, উপরের দিকে আর যায় না। এই ঝরনার উপরে আরো সাতটা ধাপ আছে, আমরা দাঁড়িয়ে আছি অস্টম ধাপের গোড়ায়!!
বিস্ময়ে মাথা বেকুব হওয়ার জোগাড়, তড়িঘড়ি করে প্রায় খাড়া ঢাল ধরে হাচড়ে পাচড়ে উঠে চললাম ঝরণার উৎসের দিকে। ঝরনার ষষ্ঠ স্টেপে এসে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা, চোখের সামনে যা দেখছি বিশ্বাস করতে কস্ট হচ্ছে! চশমা খুলে মুছে নিয়ে আবার বসালাম নাকের উপরে, না, ভুল দেখিনি – রীতিমতন আকাশ থেকেই পড়ছে ঝরনার পানি, আমার সামনে একেবারে খাড়া হয়ে ঝুলে আছে খইয়াছড়া ঝরণার ৩টা ধাপ ! প্রতিটা ধাপ থেকে সমান তালে পানি পড়ছে, মনে হচ্ছে যেন বিশাল একটা সিঁড়ি চিত হয়ে পড়ে আছে সবুজের বাজারে। প্রতিটা ধাপেই ফুটে আছে রংধনু! আমার আর আরমান ভাইয়ের অবাক হওয়া দেখে মজা পাচ্ছে বাকিরা, ওদের কাছে এই যায়গাটা পুরোনো, ওনেক আগে এরাই প্রথম খুজে বের করেছিলো এই যায়গা, কালপুরুষ অপু জানালো উপরে আরো তিনটা ধাপ আছে, সেখানে আছে একটা গভীর বাথটাব, লাফ-ডুব-সাঁতার সবকিছু ঐ জায়গার জন্যই তুলে রেখেছে তারা। এরপর উঠা শুরু হলো খাড়া ঝরনার গা বেয়ে, একেকটা ধাপে উঠছি আর অবাক হচ্চি নিচের দিকে তাকিয়ে, এও সম্ভব! একটা ঝর্ণা এতটা সুন্দর, এতো নিখুঁত কিভাবে হতে পারে! সবার উপরের ধাপে উঠে ব্যাগগুলো রেখে চললো পানিতে লাফালাফি, সে এক মুহূর্ত বটে।
বাংলাদেশের মোটামুটি অনেকগুলো ঝর্ণাই আমি দেখেছি, সৌন্দর্যের দিক থেকে সবাইকে যোজন যোজন মাইল পেছনে ফেলে এগিয়ে আছে বান্দরবানের “জাদিপাই ঝর্না”। এই ঝর্না দেখার পর আমার ঐ বিশ্বাসটা টলতে শুরু করেছে, কে বেশী সুন্দর – জাদিপাই নাকি খইয়াছড়া! গঠনশৈলীর দিক দিয়ে অদ্ভুত সুন্দর জাদিপাই’এর সাথে টক্কর বাঁধিয়ে দেবার জন্যই যেন এর উত্থান! আমার জীবনে এরকম অতিকায় সুন্দর ঝর্না আমি আর দেখিনি, এর ৮টা স্টেপের প্রতিটিতেই রয়েছে সুবিশাল যায়গা, যেখানে তাঁবু টাঙ্গিয়ে আরাম করে পূর্ণিমা রাত পার করে দেয়া যায়। একটু চুপচাপ থাকলেই বানর আর হরিণের দেখা পাওয়া যায়। অদ্ভুত সুন্দর এই সবুজের বনে একজনই সারাক্ষণ কথা বলে বেড়ায়, বয়ে যাওয়া পানির রিমঝিম ঝরনার সেই কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায় নিশ্চিন্তে।
কিভাবে যাবেন ?
পথের দিক হিসাব করলে বাংলাদেশের সবচাইতে সহজপথের ঝর্না এটা। ঢাকা থেকে গেলে চট্টগ্রামের গাড়ীতে উঠে ভোরে নেমে যাবেন মীরসরাই বাজারে, সেখান থেকে আট টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে চলে যাবেন “খইয়াছড়া স্কুলে”। খইয়াছড়া খুলের উল্টাপাশের পাহাড়ের দিকে যে পিচ ঢালা রাস্তাটা চলে গেছে সেদিকে হাঁটা দিবেন, ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট পরে নিজেকে আবিস্কার করবেন এই ঝরনার শেষ স্টেপে। এটা বাংলাদেশের একমাত্র ঝর্না যেখানে সকল মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়! বছরের পর বছর ধরে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই ঝর্ণাটা একদমই নতুন শহুরে মানুষের কাছে। এখানকার লোকজন জানেও না যে কি এক আসাধারণ সম্পদ নিয়ে তারা বসে আছে! ঢাকা থেকে যাওয়া আসার বাস ভাড়া বাদ দিলে সারা দিনে এই ঝরণার পেছনে আপনার খরচ হবে ১০০ টাকারও কম, আর সেটাও নির্ভর করবে আপনি কি খাবেন তার উপরে।


















