ছবিঃ (আব্দুল্লাহ আবু দাইয়ান)…
বাংলাদেশের যে জায়গাটাতে সবুজের দল কখনো বুড়ো হয় না, যেখানে সারাটাদিন উড়ে উড়েও একটুও ময়লা হয় না শুভ্র বকের গায়ের পালক, যেখানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলে দুস্টু বানরের দল–সেই যায়গাটার নাম সুন্দরবন। আলো আঁধারীর শ্বাসমূলের এই বনে চার পায়ে হাঁটা বাঘের সাথে প্রতিদিনই টেক্কা দেয় চিত্রা হরিণের ঝাঁক, জোয়ার ভাটার এই বনে লুকিয়ে চলা শুকরের পাল ধরতে নাক ডুবিয়ে বসে থাকে ধুসর কুমিরের ছোট্ট ছানাটা আর এলো চুলে খোঁপা বেঁধে কোমল বাতাসে দূলতে থাকে বনের গাছেরা, তাদের ডালে ডালে চলে সাপের আনাগোনা। সুন্দরবনকে বলা হয় ভয়ংকর সুন্দর একটা জায়গা যেখানে যেতে হয় শরীরের সবগুলো ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে নিয়ে, চলতে হয় তুমুল টেনশন আর কৌতূহলে দৌড়াতে থাকা শরীরের গরম রক্তকণাকে বুকে নিয়ে। বাঘ-হরিণের এই বনে আকর্ষণ যেমন আছে তেমনি আছে বিস্ময় আর চোখ জুড়ানো ভালোবাসা। এই বনে ঢুকতে হলে বন বিভাগ থেকে বিশেষ ধরণের পাশ নিতে হয়, যে কেউ যখন ইচ্ছা মন চাইলেই এখানে ঢুকে পড়তে পারে না। তবে মাঝে মধ্যে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান থাকলে বনে প্রবেশ করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো “রাসমেলা”।
রাসমেলা মূলত অনুষ্ঠিত হয় সুন্দরবনের সাগরঘেঁষা দুবলার চরে। এই চরটা খুব মজার। এখানে বছরের ছয় মাস থৈ থৈ পানি থাকে, আর ছয় মাস থাকে শুকনো বালুচর। স্থানীয় জেলেরা ঐ ছয়মাসে এখানে এসে মাছের শুটকি বানায়। এই চরে কোন নারী নেই। পুরোপুরি পুরুষদের আস্তানা হিসেবে এটি স্বীকৃত। সুন্দরবনের নীলকমল বন ফাঁড়ির পরেই সাগর পাড়ি দিয়ে দুবলার চরের অবস্থান।
গেলোবছর এই রাসমেলার কারনেই আমাদের সুযোগ হয়েছিলো বনের একেবারে ভেতর দিয়ে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়াবার। সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে ২০ জনের এক বিশাল লটবহরসহ চকচকা নতুন এক ট্রলার নিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম রয়্যাল বেঙ্গলের রাজত্বে। সারাদিন নৌকার উপরে চুপচাপ বসে থাকবো সে উপায় নেই এই প্রাণ-প্রানীদের অরণ্যে। ডান পাশে শিং বাগানো এক হরিণ দেখা যায় তো বাম পাশে অবাক হয়ে উঁকি দিতে থাকে শুকরের দল, তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করতে করতেই ঘোলা নোনা পানি ঠেলে দিনের রোদে গা গরম করতে পাড়ে উঠে আসে বুড়ো কুমিরটা। চোখে ভয় আর বিস্ময় নিয়ে কুমিরের দিকে তাকিয়ে থাকে কোনদিন ছাড়া অবস্থায় কুমির না দেখা আমাদের শহুরে অনভ্যস্ত চোখ। বিস্ময়ের ঘোর দুপ করে কেটে যায় বানরের গাছ ঝাপটানোতে, আর ঠিক দুই হাত দূরত্বেই জ্ঞানী ভাব নিয়ে বসে বসে আমাদের দেখছে নানান রঙের মাছরাঙ্গা পাখি। সারা দুনিয়ার মানুষকে অবাক করা রহস্যঘেরা এই সুন্দরবন কখনোই আমাদেরকে একা থাকতে দেয়নি, কখনো সাপ দেখে চিৎকার করে উঠেছি, আবার কখনো হরিণের বাচ্চা দেখে খুব আদুরে মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি। কখনো বানর থেকে নিজেরাই বাঁদরামিতে লাফিয়ে বেড়িয়েছি আবার কখনো শুশুক দেখে চোখে দুরবীন লাগিয়ে আরো ভালোমতন বোঝার চেষ্টা করেছি যে আসলেই জিনিসটা কি। টানা তিন দিনের এই নৌকা ভ্রমণে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো কয়েকশ সাদা বক আর নাম না জানা রঙ্গীন পাখির দল।
<!--nextpage-->
<h2>দিনের সুন্দরবন যতটা প্রাণবন্ত, </h2>রাতের সুন্দরবন যেন তার চাইতেও চাকচিক্যময়-জৌলুসে ভরপুর। এক তারা ভর্তি আকাশের নিচে যখন শুয়ে শুয়ে তারা গোনার প্রস্তুতি নিচ্ছি আমরা, ঠিক তখনি সবটুকু মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে জোনাকিরা। জীবনে যে জিনিস কখনো দেখিনি সেই অদ্ভুত জিনিসই দেখালো আমাদের তারা। সবগুলো জোনাকি একটা নির্দিষ্ট গাছের পাতায় বসে মিটমিট করছে, এরপরের দুইটা গাছ পুরো অন্ধকার, তিন নাম্বার গাছটাতে আবার জোনাকির আসর বসেছে, পরের দুইটা গাছের তাদের কোন আগ্রহ নেই, কিন্তু পরের তিন নাম্বার গাছে আবার জমেছে তাদের আলোর আসর। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ক্রিসমাস ট্রি শুধু জ্বলছে আর নিভছে! এই জিনিস যারা না দেখেছে তাদেরকে বলে বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। প্রকৃতির খুব কম মুগ্ধতাই আমরা দেখেছি, কিন্তু সুন্দরবনের রাতের যে আয়োজন প্রকৃতি করে রেখেছে তাকে ছাড়িয়ে যাবার মতন এখনো কেউ তৈরি হয়নি।
ভোরবেলাতে নীলকমল বনবিভাগের অফিসে নেমেই পেলাম বাঘের দেখা, দুটো শুকরকে দিক্বিদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে বনের রাজা। সেই দৃশ্য দেখার মতন পরিস্থিতিতে আমরা নেই, যে যার মতন পড়িমড়ি করে জান বাঁচাতে ছুটে গেলাম ওয়াচটাওয়ারে, সেখান থেকেই সবাইকে মুগ্ধ করে দিলো সকালের কুয়াশার চাদর মোড়ানো অপার্থিব সুন্দরবন। প্রতি পরতে পরতে মায়া ছড়িয়ে দেয়া বন ফেলে সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা যখন দুবলার চরের দিকে রওানা দিলাম তখনি বিশাল লাফ দিয়ে পার হয়ে গেলো এক ঝাঁক হরিণের দল, সে আরেক বিস্ময়!
<!–nextpage–>
<!--nextpage-->
দুবলার চরে যখন পৌছালাম তখন মাঝ দুপুর। রাতে জমবে মেলার নাচ গান, সুতরাং আয়োজন শুরু হয়ে গেছে সকাল থেকেই। বৈশাখী মেলার মতন স্টল বসেছে কয়েকশ! পাওয়া যায়না এমন কিছুই নেই সেখানে। রাতে শুরু হলো গানের আসর, সে আসরে তাল মিয়ালাম শহর ফেরত আমরা কিছু তরুণ। এই চরে রাতের জ্যোৎস্নাটা ছিলো অপূর্ব, পুরো সাগরজুড়ে ছিলো সেই পূর্ণিমার চাঁদের আনাগোনা-যার আলো ছড়ানো ছিলো ভোরের সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত। দুবলার চরের সমুদ্র সৈকতটা একেবারে নিরিবিলি আর ঝকঝকে নরম এক সৈকত, এখানে যতদূর চোখ পড়ে সব নারিকেল গাছের সারি আর বালুর ডিবি দিয়ে ঘেরা সমুদ্রের পাড়। আর সেই পাড়ের ধার ঘেঁসেই গড়ে উঠেছে অগুনিত শুটকিপল্লী। পুরো দ্বীপের বাতাস শুটকি মাছের এক আবেশী গন্ধে ভারি হয়ে আছে সারাক্ষণ। মানুষের মেলার সাথে সাথে সেই শুটকি খাবার জন্য জন্য জমেছে পাখিদের মেলাও। সেও এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
যদি সুন্দরবনকে পরিপূর্ণভাবে দেখতে চান তাহলে “রাসমেলা” হচ্ছে একমাত্র সুযোগ। কেননা এখানে যেতে হলে সুন্দরবনের মাঝ দিয়েই যেতে হবে। এবারো নভেম্বরের ২৪ এবং ২৫ তারিখে সুন্দরবনে রাসমেলা অনুষ্ঠিত হবে। সাজানো হচ্ছে দুলার চর, নতুন অতিথিদের চমকে দেবার জন্য প্রস্তুত চমকের ভান্ডার আমাদের সুন্দরবন…
যেভাবে যাবেনঃ
রাসমেলায় যাওয়ার দুটি রাস্তা। প্রথমটি হলো সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে নীলকমল হয়ে দুবলার চর। এবং আরেকটি হলো মংলা হয়ে কটকা সি-বিচ ফেলে দুবলার চর। রাসমেলার মৌসুমে প্রচুর নৌকা এবং ট্রলার এখন দুবলাতে যাচ্ছে। আপনাকে প্রথমেই বনে ঢোকার পাশ নিয়ে নিতে হবে, সাথে যেই ট্রলারে যাচ্ছে সেই ট্রলারের জন্য অতিরিক্ত পাশ নিতে হবে। পুরো ট্রলার রিজার্ভ নিলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। কাজেই সুন্দরবনে একটা দল হিসেবে যাওয়াটা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা কিছু সৌন্দর্য আছে যেগুলো কখনো একা দেখতে হয় না, সৌন্দর্য সবাইকে নিয়ে দেখতে হয়। টনা তিন দিনের ট্রলার জার্নিতে দিনে ঘুমালেও রাতে চেষ্টা করবেন না ঘুমিয়ে থাকতে। কারণ সুন্দরবন রাতের বেলাতেই যেগে উঠে। এর তারাভরা আকাশ এক কথায় অপূর্ব। ভালো কথা, দুবলার চলে কোন মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, কাজেই পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে যাবেন। আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো – বনের ভেতর দিয়ে যাবার সময় উচ্চস্বরে মাইক বাজাবেন না, এতে করে পশুপাখিদের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যহত হয়। বনের অপচনশীল কিছু ফেলবেন না। বাঘের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করবেন না। কারণ এই বাঘ আমাদের গর্ব, আমরাই এই বাঘের সুরক্ষা করবো”।