
অমিয়াখুম যেতে হলে পাড়ি দিতে হয় থানচি থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত পাথুরে সাঙ্গু নদী। এই নদীর তলদেশে থোকায় থোকায় থাকা পাথরকণা হার মানিয়ে দেয় মুক্তোদানাকেও… লিখেছেন রাকিব কিশোর
সেই রাতের কথা আজীবন মনে রাখব, বিছানার নিচে কুকুর, ছাগল, মুরগি, গরু আর শূকরের মিশ্রিত ডাক, আর মাথার ওপরে অবাক চাঁদের মৌন হাতছানি, অস্থির!আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম মাটি থেকে তিন-চার ফুট উঁচুতে বানানো চারপাশ খোলা একটা টংঘরে, এখানে মে মাসের প্রচণ্ড গরমের রাতে শীতে কাঁপতে কাঁপতে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর কী যে আরাম, তা কারে বোঝাই! তার ওপর মাঝরাতে যখন চোখ মেলেই দেখি আকাশে আধখানা চাঁদ তার ঘোলাটে হলদে আলো দিয়ে আমাদের দেখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তখন মনে হয়, আসলেই ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’!
পরের রাস্তাটুকু আতঙ্কের, জীবনে কখনো এত খাড়া পাহাড়ি রাস্তা ধরে নামিনি, পুরো ৮৫ ডিগ্রি কোণে নামতে হচ্ছে প্রায় হাজার ফুটের পাহাড়! নইচ্চেন তো মইচ্চেন অবস্থা। ভাগ্যকে বারবার দোষারোপ দিলাম সঙ্গে করে রশি আনিনি বলে। টানা ৪০ মিনিট থরথর করে কাঁপা পা নিয়ে পুরো খাড়া পাহাড় নেমে ঢুকলাম ঘন জঙ্গলের রাজ্যে। আমাদের সামনে আকাশছোঁয়া গোল গোল পাথরের দেয়াল, তার মধ্য দিয়ে ঝরঝর করে বয়ে চলছে সবুজ পানির কোলাহল। এখানে-ওখানে জমে সেই পানি রূপ নিয়েছে একেকটা লেগুনে। স্বচ্ছ সেই লেগুনের বুকে অলসভাবে সাঁতরে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল সব মাছের দল, কারও কোনো তাড়া নেই, কোথাও যাওয়ার তাগিদ নেই।
আমাদের গাইড তাগাদা দিল, এসব নাকি কিছুই না, বামে অমিয়াখুম আর ডানে সাতভাইখুম। সেখানে গেলে আমরা নাকি মাথা ঘুরে পড়ে যাব এমন সুন্দর!
ছুট লাগালাম জল-পাথরের আড্ডা ছেড়ে জলের পাঠশালায়। এ পাথরের ওপর দিয়ে ও পাথরের তলা দিয়ে যখন দাঁড়ালাম, তখন তীব্র ঘামের মধ্যেও মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যাওয়া শীতল পানির ধারার অস্তিত্ব টের পেতে ভুললাম না, অবাক চোখের সামনে নিজেকে খোলামেলা করে মেলে ধরেছে বান্দরবানের সবচেয়ে সুন্দর এই জায়গা। ভরদুপুরের আলোয় অদ্ভুত রহস্যলাগা সৌন্দর্য নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে অনাদিকাল থেকে রূপ ধরে রাখা পাহাড়ি ঝরনা ‘অমিয়াখুম’।
এমন পানিতে ঝাঁপ না দেওয়া গুরুতর অন্যায়। আমি তোড়জোড় শুরুর আগেই দেখি সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাঁতার না-জানা অপু ভাই, গায়ে তার লাইফ জ্যাকেট! পানির চাপ অগ্রাহ্য করে চলে গেলাম এক্কেবারে ঝরনার গোড়ায়। অমিয়াখুমের দুই পাশের পাহাড়ের গঠনশৈলী পুরোটাই অন্য রকম, সিঁড়ির পরে সিঁড়ি জমেছে এখানে, সেগুলোর ধাপ আবার এত বড় যে একেকটা ধাপে তাঁবু টানিয়ে আরাম করে ঘুমানো যাবে।
ভেবেছিলাম এবারের মতো ভালো লাগার বুঝি সমাপ্তি হলো, কিন্তু সে ধারণা ভেঙে দিল সাতভাইখুম নামক জায়গা। অমিয়াখুম থেকে একটু ওপরের দিকে বাঁশের ভেলায় চড়ে যেতে হয় সাতভাইখুমে। মাত্র ১০ মিনিটের এই পানির রাস্তার কাছে নস্যি দুনিয়ার সপ্তাশ্চর্যও! জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল এবার। ওজন সইতে না পেরে টুপ করে ডুবে গেল আরমান আর শিপন ভাইদের ভেলা, সেটা দেখে সাঁতার না-জানা আলো ভাইয়ের চেহারা হলো দেখার মতো।
আমরা একটা পাথরের দুর্গে ঢুকলাম, নিজেদের প্রথমবারের মতো বোবা মনে হলো। চোখের সামনে যেন পাথরের সভা বসেছে। জীবনে এত বড় বড় পাথর আমি কখনো দেখিনি। পুরো বান্দরবান যেন এখানে একসঙ্গে ধরা দিয়েছে, এখানে তিন্দুর মতো বড় বড় পাথরও আছে, আছে অমিয়াখুমের মতো সিঁড়ি সিঁড়ি ঝরনা, আছে বগা লেকের মতো স্বচ্ছ পানির হ্রদও।

যেভাবে যাবেন
বান্দরবানে পৌঁছে সোজা চলে যাবেন থানচিতে। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে থামবেন রেমাক্রিতে। এরপর আর কোনো গাড়ি যাবে না, পায়ের ওপরে ছেড়ে দিতে হবে শহুরে হাওয়ায় পেলে পুষে বড় করা শরীরটাকে। চলতি পথে নাফাখুম পড়বে, সেখান থেকে যেতে হবে জিনাপাড়া। এখানে হুটহাট ছবি তুলবেন না।খেয়াল রাখবেন তাদের সংস্কৃতিতে যেন কোনো আঘাত না লাগে। সেখানে রাতে থেকে পরদিন খুব ভোরে অমিয়াখুম আর সাতভাইখুমের দিকে হাঁটা দেবেন। সঙ্গে করে রশি, লাইফ জ্যাকেট আর খাবার নিয়ে যাবেন। ফিরে আসার পথে ‘পদ্মমুখ’ রাস্তা দিয়ে ফেরত আসতে পারেন। সে ক্ষেত্রে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে অনেক আগেই আপনি থানচিতে পৌঁছাতে পারবেন। অমিয়াখুম ও সাতভাইখুম ভালোভাবে ঘুরে আসতে চার দিন লেগে যাবে। গাইডরা এখন একটা প্যাকেজ চালু করেছে, সে প্যাকেজ অনুযায়ী শুধু থানচি থেকে সব ঘুরে আবার থানচিতে ফেরত আসতে আপনার মোট খরচ হবে দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। এই জায়গা দুর্গম, ভারী জিনস আর ট্রলি ব্যাগ না নিয়ে যাওয়াই ভালো